গত বছর ডিসেম্বরের ১০ তারিখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেখ হাসিনার খুনি বাহিনী র্যাবের গুটিকয়েক লোকের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে গুমখুন এবং বন্দুকযুদ্ধের নামে রাষ্ট্রীয় হত্যা কিছুদিন বন্ধ থাকার পর সম্প্রতি আবার শুরু হয়েছে। আসলে নরখাদক খুব বেশিদিন মানুষ হত্যা না করে থাকতে পারে না। আর স্যাডিস্ট শেখ হাসিনা যে নিয়মিত রক্তের গন্ধ না পেলে উন্মত্ত হয়ে ওঠেন সেটা তারই ব্যক্তিগত সহকারী মতিউর রহমান রেন্টু বহু বছর আগেই লিখে গেছেন। তিনি লিখেছিলেন দেশে রক্তক্ষয় না হলে তার নাকি ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। রেন্টুর গল্প সত্যি হলে, একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবীর একমাত্র মহিলা স্বৈরশাসকের কিছুদিন হয়ত ঘুমাতে বেশ সমস্যা হয়েছে। ডেথ স্কোয়াডের কাজ পুনর্বার শুরু হয়ে যাওয়ায় তিনি নিশ্চয়ই নাক ডেকে আবার ঘুমাতে পারছেন। শেখ হাসিনার নিদ্রা নিয়ে গবেষণা আজকের সম্পাদকীয়র মূল বিষয় নয়। কেন হত্যাকাণ্ড মাস চারেক বন্ধ ছিল আর এখন শুরুই বা হল কেন সে সম্পর্কে আলোচনাই আমার উদ্দেশ্য।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস পালন উপলক্ষ্যে বাংলাদেশের কয়েকজন রাষ্ট্রীয় খুনির বিরুদ্ধে বাইডেন প্রশাসন আচমকা নিষেধাজ্ঞা দিলে ঢাকার মাথায় বাজ পড়েছিল। একদিকে ক্ষমতাসীনরা যেমন দৃশ্যত বিচলিত হয়ে পড়েছিল, অপরদিকে বিরোধী শিবিরের আনন্দের সীমা ছিল না। নানারকম গুজবে সয়লাব হয়ে গিয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়া। সবাই বলতে থাকলেন কানাডা, ব্রিটেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞাও এলো বলে। ফ্যাসিস্ট সরকারের উচ্ছিষ্টভোগী, নষ্ট বুদ্ধিজীবী কলিমু্ল্লাহ হঠাৎ করে ভোল পাল্টে টেলিভিশন টক শো’তে দাবী করলেন যে, আরো পাঁচশ খুনির তালিকা নাকি ওয়াশিংটন তৈরি করে ফেলেছে যা কয়েকদিনের মধ্যেই ঘোষণা করা হবে। এমনভাবে তিনি একথা বললেন যেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন তাকে নিজে ফোন করে এই তথ্য জানিয়েছেন। অবাক কান্ড, তার বিরুদ্ধে সরকার গুজব ছড়ানোর অভিযোগে কোন ব্যবস্হাও নিল না। অনেকে বলে এই লোকটি নাকি বাংলাদেশে ইসরায়েলী কুখ্যাত গোয়েন্দা মোসাদের একজন এজেন্ট হতেও পারে।
যাই হোক, মনে হলো এই বিনা মেঘে বজ্রপাতে সেনাবাহিনী এবং পুলিশ খানিকটা ভড়কেও গেছে। বিরোধী দলের ভীতু নেতাকর্মীরা প্রবল উৎসাহের সাথে বলতে লাগলেন, পুলিশের আচরণে নাকি বেশ ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। আগের তুলনায় তাদের কর্মসূচিতে কিছুটা লোকও বাড়তে লাগলো। শেখ হাসিনাও সময়ক্ষেপন না করে তার মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের পশ্চিমা রাজধানীতে পাঠিয়ে তদবির শুরু করলেন। সেই তদবিরের কারণে কিনা জানিনা, তবে অন্যান্য পশ্চিমা দেশ মার্কিন পদক্ষেপ অনুসরণ করল না। বিষয়টা নি:সন্দেহে ব্যতিক্রমী। অন্যান্য দেশ যেমন, রাশিয়া, বেলারুশ, উত্তর কোরিয়া, মিয়ানমার ইত্যাদির ক্ষেত্রে প্রায় সর্বদাই দেখা গেছে, এই জাতিয় স্যাংকশন পশ্চিমারা জোট বেধেই দেয়। তারপরও সরকারের মধ্যে সন্দেহ কাজ করছিল যে ওয়াশিংটন থেকে আরো নিষেধাজ্ঞা আসে কিনা। সঙ্গত কারণেই রাষ্ট্রীয় খুন বন্ধ রাখতে হচ্ছিল। এর মধ্যে একজন মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি ঢাকা সফর করলেন। শেখ হাসিনা নানান টালবাহানা করে তাকে সাক্ষাৎ দিলেন না। তাতে মার্কিন প্রশাসন খুব একটা মনক্ষুন্ন হয়েছে এমন প্রমাণ পাওয়া গেল না। বরং বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ওয়াশিংটন সফরে গিয়ে সে দেশের সেক্রেটারি অব স্টেট ব্লিংকেনের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করলেন। বৈঠককালে কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়ে আর একটু হলে ব্লিংকেনের রীতিমত কদমবুচি করে ফেলেছিলেন পরচুলা মন্ত্রী নামে খ্যাত বাংলাদেশি মন্ত্রী আবদুল মোমেন। গোলাম শ্রেণিদের আবার মানসম্মান কি? আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এই জাতিয় নির্লজ্জ মেরুদণ্ডহীনদের শ্বেতাঙ্গরা পছন্দই করে। খুনিদের ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠে না গেলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না এমন কোন আশ্বাস নিয়েই সম্ভবত আবদুল মোমেন ঢাকায় ফিরেছেন। এরই প্রেক্ষিতে বিচারবহির্ভূত হত্যা আবার শুরু করে শেখ হাসিনা মানবাধিকার প্রশ্নে মার্কিন অবস্থান পরিষ্কার করে বুঝতে চাচ্ছেন। এই বোঝাপড়াটা তার জন্য জরুরী। কেন জরুরী এবার সেটা ব্যাখ্যা করছি।
শেখ হাসিনা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আছেন। ২০০৮ সালে তাকে ভারত এবং আমেরিকা জোট বেধে একটা সাজানো নির্বাচনে ক্ষমতায় এনেছিলো। ২০১৪ সালে আবারও ভারতের সরাসরি হস্তক্ষেপে একদলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে তিনি ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন। সেবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা অসন্তুষ্ট হলেও দিল্লির তৎকালিন কংগ্রেস সরকার ওয়াশিংটনে দৌড়ঝাঁপ করে ‘BUSINESS AS USUAL’ এর ব্যবস্হা করেছিল। সেই সময় বাংলাদেশের গণতন্ত্র হরণে জাপানেরও একটা ভূমিকা ছিল। তৎকালিন জাপানী প্রধানমন্ত্রী সিনজো আবে’র বিরুদ্ধে ইসলামোফোবিয়ার অভিযোগ আছে। ২০১৮ সালে ড: কামাল হোসেনকে ভাড়া করে এনে বেগম জিয়াকে জেলে রেখে দিয়ে অনেক আশা নিয়ে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। আশা ছিল ক্ষমতা না পেলেও সম্মানজনক আসন নিয়ে সংসদে যাওয়া সম্ভব হবে। বিরোধী দল শেখ হাসিনাকে এখনও চিনতে পারে নাই। ২০১৮ সালে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার কষ্টটাও জনগণকে করতে হল না। নির্বাচনের আগের রাতেই হাসিনার খুনি পুলিশ, র্যাব এবং বিজিবি ব্যালট বাক্স ভরে রেখেছিল। ভোটাররা পরদিন সকালে ভোটকেন্দ্রে গেলে তাদের জানিয়ে দেওয়া হয় যে, ভোট দেয়া হয়ে গেছে। কেউ প্রতিবাদ করলে তার কপালে উত্তম-মধ্যম আর জেল জুটেছিল। বাংলাদেশে এক মহা দুর্নীতিপরায়ণ, স্বৈরতন্ত্রের উত্থানে দেখা গেল ভারতের সাথে চীনও বেজায় সন্তুষ্ট। কোন দেশে এই প্রকৃতির স্বৈরশাসন থাকলে ব্যবসায় খুব মজা। চীনের সন্তুষ্টিতে আমেরিকা এবার অসন্তুষ্ট হলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ বছরের মানবাধিকার রিপোর্টেও তাই পরিষ্কারভাবেই ২০১৮’র নির্বাচনে ডাকাতির কথা বলা হয়েছে। প্রথমবার সেনাবাহিনী দিয়ে সাজানো, দ্বিতীয়বার একদলীয় এবং তৃতীয়বার নিশিরাতের ডাকাতি, এই হলো শেখ হাসিনার ক্ষমতার ইতিহাস।
২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনী তামাশা সফল করতে শেখ হাসিনা হাজার হাজার বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের খুন করেছেন, পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন করে পঙ্গু করেছেন এবং জেলে পুরেছেন। ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে আগামী বছরও একই ভাবে গণহত্যা চালিয়ে কোন নতুন কৌশলে ভোট ডাকাতি করতে হবে। তিনি ক্রমান্বয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং গুমখুন আবার চালু করে সেই ক্ষেত্র তৈরি করতে চান। শেখ হাসিনাকে এই বছরের মধ্যেই বুঝতে হবে তার সরকারের কতদূর বর্বরতা মার্কিন প্রশাসন ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মানতে প্রস্তুত। সেই অনুযায়ী তিনি নির্বাচনী কৌশল নেবেন। এক দফার চূড়ান্ত আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিরোধী দলগুলোর দ্বিধাদ্বন্দ শেখ হাসিনাকে আরো জুলুম নির্যাতনের সুযোগ করে দিচ্ছে। তাছাড়া, এখন পর্যন্ত ভোট ডাকাতির সংসদে বিএনপির গুটিকয়েক চরম সুবিধাবাদীর উপস্থিতি হাসিনাকে একপ্রকার বৈধতাও দিচ্ছে। তাদেরকে ওখানে রেখে বিএনপি কি রাজনৈতিক সুবিধা লাভ করছে সেটা দলের নেতারাই ভাল জানেন। পাকিস্তানের পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশের বিরোধী দল চাইলে শিক্ষা নিতে পারে। ফ্যাসিবাদকে হঠাতে হলে একতা এবং সাহসের কোন বিকল্প নাই। জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে রাস্তায় নামতে পারলে বাইডেন প্রশাসনকে দিল্লির অনিচ্ছা সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে অবশ্যই সমর্থন করতে হবে। পুরনো কথা আবারও বলছি। ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তির শান্তিপূর্ণ একমাত্র পথ গণঅভ্যুত্থান।

Comments