top of page

তৈল কীর্তন !

Md Najmul Hasan Khan

খবরে প্রকাশ, হঠাৎ করিয়া সয়াবিন তৈলের দাম বাড়িয়া যাওয়ায় বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রীকে সমালোচনা শুনিতে হইয়াছে (ডেইলি স্টার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২১)। মন্ত্রী মহোদয় অভিযোগ খণ্ডন করতঃ এহেন মূল্য বৃদ্ধিকে একটি বৈশ্বিক সমস্যা হিসাবে আখ্যায়িত করিয়াছেন।


যাহাই হউক, তৈল বড়ই প্রয়োজনীয় একটি বস্তু। ইহা ছাড়া পৃথিবী অচল প্রায়। চারিদিকে তৈল লইয়া সর্বক্ষণই ঘটিতেছে হৈহৈ কান্ড, রৈরৈ ব্যাপার। কথায় আছে, ‘অন্ন বিনা চর্ম দড়ি/তৈল বিনা গায়ে খড়ি’। শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য সঙ্কলিত ‘বাংলার লোকসাহিত্য’ গ্রন্থে শরীরে তৈল মাখিবার ‘স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতির’ বর্ণনা লিপিবদ্ধ আছে, “পায়ে তৈল মাখিয়া পরে গায়ে মাখিতে হয়; সবশেষে মাথায় তৈল দিয়া স্নান করিতে যাইতে হয়”। মহাভারতেও ইহার স্বীকৃত মিলে। শরীরে তৈল না মাখিতে পারিলে তাই অনেকেরই প্রাতস্নান সুসম্পন্ন হয় না। ইহা ছাড়া, কুপিবাতি এবং গরুর গাড়ির চাকা হইতে শুরু করিয়া মঙ্গল গ্রহে রকেট পাঠাইতে হইলেও তৈলের প্রয়োজন হয়। এক কথায়, তৈল নিত্য অপরিহার্য এবং সর্বসংকট ধন্বন্তরি একটি মহামূল্যবান দ্রব্য।


এই রচনায়, আমি আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে তৈল এবং তৈল সংশ্লিষ্ট কতিপয় তেলেসমাতি বিষয়ে যদ্যপি সম্ভব আলোকপাত করিয়া কিছু কথা বলিতে মনস্থ করিয়াছি। তৈলের গুণকীর্তন অবশ্য স্বল্প কথায় বলিয়া সাঙ্গ করা যাইবে না। তৈল লইয়া অতীতে নানাজনে নানা কথা বলিয়াছেন, বহু আঙ্গিকে বহু লেখালেখিও হইয়াছে। তাই,নতুন করিয়া তৈল সম্পর্কে তেমন কিছু বলিতে গেলে চর্বিত চর্বণ হইবার সম্ভাবনাও থাকিয়া যায়। সেইহেতু, লেখার শুরুতেই সকল পাঠকের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছি। আশা করি, তৈল ব্যবহারকারী হইতে শুরু করিয়া নন্দিত এবং নিন্দিত তৈল বিশারদেরা আমার এই লেখাটি পড়িয়া অতি মাত্রায় অসন্তুষ্ট হইবেন না।


যাহাই হউক, তৈল বিনা আরাধনা সম্পূর্ণ হয় না, রাজা উজিরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন হয় না, পীর-সাধুর প্রতি দক্ষিণা দেওয়া যায় না,এমন কি স্বামী কিংবা স্ত্রীর মন পর্যন্ত জয় করা যায় না।


তবে, তৈলের ব্যবহার ও গুরুত্ব নতুন কিছু নহে। ইজরায়েলের ইতিহাসে তৈল সমৃদ্ধি, আশীর্বাদ এবং স্থিতিশীলতাকে নির্দেশ করে (জোয়েল ১:১০)। কথিত আছে, রাণী এস্টার তাঁহার সৌন্দর্য চর্চায় অলিভের তৈল ব্যবহার করিতেন। মহাভারতে বিবৃত পঞ্চামৃতের মধ্যে ঘৃত অন্যতম। গন্ধতৈলসহ পঞ্চামৃত ভগবানের অভিষেক ছাড়াও মানসিক এবং শারিরীক রোগ বালাই দূরীকরণের জন্য মহৌষধ বলিয়া গণ্য করা হয়।


সপ্তদশ শতকে কবি কঙ্কণ চণ্ডী তাঁহার লেখায় “তৈল,তামাক, তপন, তুলা, তপ্ত ভাতে ঘি” এর কথা উল্লেখ করিয়াছেন (তাম্বুলং তপনং তৈলং তুলা তন্বী তনুনপাৎ)। ইহার মানে হইল, শরীরে তৈল, তামাক ডলিয়া রৌদ্রস্নান করিবে; অতঃপর, গরম ভাতে ঘৃত সহকারে আহার সম্পন্ন করিবে।


তৈলের অপরিসীম গুরুত্ব এবং উহার দুর্মূল্যের কারণে অধিকাংশ মানুষই তৈল যথেষ্ট হিসাব করিয়া খরচ করেন। ইহা আমার বাল্যকালে শ্রুত একটি লোকজ ছড়ায় বড়ই সুন্দরভাবে ফুটিয়া উঠিয়াছে, ‘এক পয়সার তৈল,/কিসে খরচ হৈল,/তোমার দাড়ি আমার পায়/আরও দিলাম ছেলের গায়,/ছেলেমেয়ের বিয়ে হৈল,/সাতরাত গান হৈল,/কোনও অভাগী ঘরে গেল,/বাকি তেলটুক নিয়ে গেল।’


তৈলের অপচয় কিংবা তৈলের শিশি ভাঙ্গাকে কেহ কেহ অমঙ্গল ও অপয়া বলিয়া গন্য করিয়া থাকেন। স্বর্গীয় অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁহার ভারতবিভাগ জনিত আক্ষেপ প্রকাশ করিতে গিয়া বলিয়াছিলেন, 'তেলের শিশি ভাঙল বলে খুকুর পরে রাগ করো।/তোমরা যে সব বুড়ো খোকা ভারত ভেঙে ভাগ করো!/তার বেলা? তার বেলা? তার বেলা?'


বহুবিধ ব্যবহারের কারণে তৈলের চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইলেও সরবরাহ অপ্রতুল হওয়ায় তৈলের মূল্য হু হু করিয়া বাড়িয়াই চলিয়াছে। ফলে, এক পয়সায় এখন আর তৈল মিলে না এবং তৈল উৎপাদনকারী দেশ সমূহ তৈল বাণিজ্যের মাধ্যমে ফুলিয়া ফাঁপিয়া ধরাকে সরা জ্ঞান করিতেছে। কোটি কোটি তৈল ডলার (পেট্রো ডলার) আয় করিয়াও উহারা তৈল লইয়া রাজনীতি করিয়া এবং ইচ্ছামাফিক তৈলের দাম কমাইয়া বাড়াইয়া গোটা বিশ্বকে জিম্মি করিয়া রাখিয়াছে। বিশেষ করিয়া, মূল্যের এই অসংলগ্ন এবং অস্থির ওঠানামা বাংলাদেশের মত দেশের বাণিজ্য বিষয়ক মন্ত্রীর জন্য বড়ই বিব্রতকর ও বিপজ্জনক। স্থানীয় বাজারে তৈলের দাম কমাইতে গেলে সরকারের লোকসান, আবার দাম বাড়িলে জনগণের প্রতিবাদ, বাস ট্রাক বন্ধ। ইহা যেন এক শাঁখের করাত!


তৈল সর্বত্রগামী। পিচ্ছিল প্রকৃতির তরল বিধায় ইহা দ্রুততার সহিত এক স্থান হইতে অন্যস্থানে অনায়াসে চলাচল করিতে সক্ষম। তবে ইহা অপরাপর তরলের তুলনায় যৎকিঞ্চিৎ ভিন্নধর্মী। পানি সহ অন্যান্য তরল পদার্থের অন্যতম প্রধান ধর্ম হইল, ইহারা সকল সময়েই নিম্নগামী। কিন্তু তৈল সুবিধামাফিক অধঃ কিংবা উর্ধ্ব, আঁকাবাঁকা কিংবা বন্ধুর, সকল দিকেই অনায়াসে ছুটিয়া যাইতে সক্ষম। সেই কারনেই তৈল আম পাবলিকের কাছ হইতে ছোট সাহেব, ছোট সাহেব হইতে বড় সাহেব, এবং তথা হইতে প্রয়োজন মাফিক আরও বেশী বড় সাহেব কিংবা অপর যে কোন গন্তব্য অভিমুখে ধাবিত হইতে সক্ষম। ফলস্বরূপ, চারিদিকে শুধু তৈলেরই অবাধ বিচরণ - জয় জয়কার।


তৈল অঘটন ঘটন পটীয়সী। বিজ্ঞজনেরা বলিয়া থাকেন,,‘তৈল ঢালিলেই কাজ হাসিল’ কিংবা 'তেলামাথায় ঢাল তেল, রুক্ষমাথায় ভাঙ বেল'। তাই, হুজুরের মন পাওয়ার জন্য তৈলমর্দন প্রতিযোগিতা এখন এক নৈমিত্তিক ব্যপার হইয়া দাঁড়াইয়াছে। কে কাহার আগে হুজুরকে তৈলমর্দনে খুশী করিয়া কার্য সিদ্ধি করিতে পারিবে, ইহা লইয়া বচসা, এমন কি খুনাখুনি পর্যন্ত ঘটিয়া যাইতেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, তেলা মাথায় তৈল প্রদান করা হয়। যাহার মাথায় যত তৈল, তাহার মাথার প্রতিই তৈলবাজদের দৃষ্টি কত বেশী আকর্ষিত হয়। সেই মাথা যদি কেশবিহীন হয়, তাহা হইলে তো সোনায় সোহাগা – তৈলচর্চিত মাথা হিরা মাণিক্যের মত চকচক করিতে থাকে। ইহার প্রদর্শনী এবং উহা লইয়া বড়াই করিতে মাথার মালিক যেমন পিছপা হন না, একই ভাবে গুণগ্রাহীরা উহার চাকচিক্য বজায় রাখিতে একই মাথায় বারংবার তৈল ঢালিয়া কৃতার্থ বোধ করেন। উহারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, জায়গামাফিক মাথা বাছিয়া তৈল প্রদান করিতে পারিলে অনেক মুশকিল আসান হইয়া যায়।


তৈলের দালালেরা এই সুযোগে তৈলবাজ এবং তৈলখোরদের নিকট হইতে মধ্যসত্ত্বভোগী হিসাবে মুনাফা আদায় করিয়া থাকে। এইসব দালাল যথাস্থানে, যথাসময়ে এবং সঠিক মস্তিষ্কে তৈল প্রয়োগের মাধ্যমে এই জাতীয় উদ্দেশ্য চরিতার্থে সহায়তা করিয়া থাকে। নির্বাচনে মনোনয়ন হইতে শুরু করিয়া ব্যাংক হইতে ঋণ আদায় পর্যন্ত তৈলের দালালীর কোন বিকল্প নাই। তৈল এবং এতদসংক্রান্ত যাবতীয় কমিশনের যোগারযন্ত্র সংশ্লিষ্ট মক্কেলগণকেই করিতে হয়।

অনেক বিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ মনে করেন, এহেন তৈলের প্রবাহ দেশের উন্নতির ধনাত্মক ধারাকে জোরদার করিতে সহায়তা করে। সেই সুবাদে, অর্থনীতির চাকা সচল রাখিতে এবং ব্যাবসা-বানিজ্য ও উন্নয়নের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টিতে তৈল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখিতে সক্ষম। ইংরেজি ভাষায় একটি প্রচলিত প্রবচন আছে, ‘grease the hand of’ যাহার শাব্দিক অর্থ ‘হস্ত তৈলাক্ত করা’ হইলেও আভিধানিক অর্থ ‘ঘুষ’ বা ‘উপরি’। অর্থাৎ, জায়গামত এবং সময়মত হস্ত তৈলাক্ত না করিতে পারিলে সরকারী অফিসের ফাইল পত্র সহজে চলাচল করিতে পারে না; ইহার অবর্তমানে ঠিকাদারি মিলে না, উন্নয়নের নকশা অনুমোদিত হয় না, চাকুরীর প্রমোশন হয় না, বিকল গাড়ি কিংবা ত্রুটিযুক্ত স্টিমারের লাইসেন্স ও ফিটনেস যোগাড় হয় না…। মামলা করিতে, মামলা চালাইতেও তৈলের প্রয়োজন হয়। জনশ্রুতি আছে, তৈলের যথার্থ প্রয়োগ ছাড়া প্রেম-ভালোবাসা, এমন কি কবিদের পুরষ্কার পর্যন্ত মিলে না।


সিঁধেল চোরেরা সর্বাঙ্গে তৈল মাখিয়া চৌর্যকর্মে ব্যপৃত হয় যাহাতে ধরা পড়িলে উহাদের পিচ্ছিল শরীর গৃহস্থের হাত ফসকাইয়া ছুটিয়া যাইতে পারে। কাঁঠালের আঠা হইতে মুক্তির জন্যও তৈলের দরকার হয়। তাই অনেকেই গাছে কাঁঠাল থাকিতেই তৈলের যোগার যন্তর করিয়া রাখন। একই কারণে, সকল অপকর্মের আগে করিৎকর্মা তৈলবাজেরা নিজেরা তৈলচর্চিত হইয়া অপরের শরীরে তৈল মর্দন করেন যাহাতে যে কোন অপকর্মের পর আইনের আঠা হইতে সংশ্লিষ্ট সকলেই মুক্ত থাকিতে পারেন।


তৈল ছাড়া খাবার সুস্বাদু হয় না, ভাজা হয় না মচমচে। তবে মজাদার হইলেও উহা যদি হয় অপরিশুদ্ধ কিংবা ভেজালযুক্ত, তাহা স্বাস্থ্যের জন্য হানিকর হইতে পারে। অনেকে অবশ্য বলেন, তৈলে যৎকিঞ্চিত ভেজাল থাকিলে ক্ষতি আর তেমন কি? কিংবা, সরিষার তৈলে পাম অয়েল ও ঝাঁঝযুক্ত রাসায়নিক; অলিভ অয়েলে সয়াবিন; সোয়াবিন তৈলে পাম অয়েল, পোড়া মবিল ও খনিজ তৈল;এবং ঘিতে পশুর চর্বির ভেজালে কি আর তেমন আসে যায়! বহুকাল যাবত জিলাপির প্যাঁচ লইয়া নানা কথা চাউর হইলেও রমজান মাসে রাস্তার পাশে প্রকাশ্যে পোড়া মবিলে ভাজা জিলাপি খাইতে মন্দ তো লাগে না। কথায় আছে, কুইনাইন ম্যালেরিয়া সারাইলেও কুইনাইন কে সারাইবে। এইক্ষেত্রে তৈল ব্যতিক্রমধর্মী।

ভেজাল তৈলের করিৎকর্মা ব্যবসায়ীগন যথাস্থানে তৈল ঢালিয়া যাবতীয় আপদ বালাই সারাইয়া ফেলেন। নানাবিধ ভেজালের বৈচিত্র্যময়তা তাই আমাদের শরীরের বারটা বাজাইলেও আমাদের রসনাকে উদ্দীপ্ত করে। বাল্যকালে যাদবের অংক কষিতে গিয়া কিভাবে দুধে পানি মিশাইয়া টুপাইস আয় করা যায়, তাঁহা রপ্ত করিয়াছিলাম। কবি সুকান্ত এই প্রসঙ্গে বলিয়াছেন, “ভেজাল তেল আর ভেজাল চাল, ভেজাল ঘি আর ময়দা, ‘কৌন ছাড়ে গা ভেজাল ভেইয়া, ভেজালসে হায় ফয়দা’”।


বাঙালীর তৈলপ্রীতি সত্যিই প্রবাদতুল্য। একই সাথে উহাদের তৈলভীতিরও কমতি নাই। কথায় আছে, ‘তেলে তামাকে পিত্তনাশ, যদি হয় তা বারমাস’। অর্থাৎ,অতিরিক্ত তৈলের ব্যবহার কিংবা দীর্ঘসময় ধরিয়া তৈলাক্ত খাবার গলাধঃকরণ করা সাস্থ্যসম্মত নহে – এমন কি তৈল নির্ভেজাল হইলেও নয়। বাংলার লোক সাহিত্যে বর্ণিত আছে, ‘তেলের বাটি গামছা হাতে গিয়েছিলুম নাইতে,/পা পিছলে পড়ে গেলুম বধুর পানে চাইতে’। অর্থাৎ,অভিনিবেশ সহকারে তৈলের সংগ্রহ ও ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়। অন্যথায়, পিছলাইয়া পড়িয়া অনর্থ ঘটিতে পারে। আর তৈলাক্ত বাঁশ বাহিয়া বানরের ওঠানামার বিরম্বনাময় গল্প তো বাঙ্গালী কিশোর কিশোরীরা অংক কষিতে কষিতেই মস্তিষ্কে ধারণ করিয়া ফেলে। তৈলের ব্যবহার তাই সতত সুখের নহে। মহাভারতের অশ্বমেধ পর্বে সুধম্বাকে তপ্ত তৈলে নিক্ষেপ করা হইলেও উহা তাঁহার কোন ক্ষতি করিতে পারে নাই। তবে, মনুসংহিতায় তপ্ত তৈল ঢালিয়া ধৃষ্টতার সাজা প্রদানের কথা বলা হইয়াছে। ভীষ্মের নীতি কথন মতে, “মহতের নিন্দা শুনি হাসে যেইজন,/তপ্ত তৈল তার কর্ণে করয়ে সেচন”। অর্থাৎ, তৈল সকল সময়ে সুখকর নাও হইতে পারে।


তৈলকে অনেকে গুণীজনই যেহেতু সার্বজনীন সংকট নিবারক হিসাবে আখ্যায়িত করেন, আমি ভাবিয়াছিলাম, তৈল প্রয়োগোর মাধ্যমে করোনা হইতে নিস্তার পাওয়ার কোন একটি উপায় উদ্ভাবিত হইবে। তবে, দেখিয়া শুনিয়া মনে হইতেছে, তৈল করোনা নিরোধ না করিয়া বরঞ্চ উহার বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করিতেছে। তৈল পড়া কিংবা তৈল মর্দনে করোনার কোন ক্ষতি হইতেছে না, বরঞ্চতৈল প্রয়োগের কারণে করোনা বিরোধী সকল প্রচেষ্টা পথ হারাইতেছে বলিয়া অনেকেই বলিয়া বেড়াইতেছেন। ভুয়া করোনা পরীক্ষা, টিকা লইয়া ঠগবাজিসহ ওষুধপত্র,যন্ত্রপাতি, ভেন্টিলেটর ইত্যাদির খরচাদি লইয়া হরিলুট চলিতেছে বলিয়া খবরে প্রকাশ। এমন কি চিকিৎসকদের খাবারের আকাশচুম্বী খরচ লইয়াও বাজারে নানাহ জল্পনা কল্পনা বিদ্যমান। তবে তৈলের অলৌকিক প্রভাবে এই সকল গুরুতর কার্যক্রমের কোনরূপ ব্যাঘাত ঘটিতেছে না। উপরন্তু, করোনাকালীন সময়ে তৈলের ব্যবহার ও চাহিদা যারপরনাই বৃদ্ধি পাইয়াছে! তৈলের মূল্য বৃদ্ধির সহিত করোনার এই যোগসূত্রটি মাননীয় মন্ত্রী অবশ্য তাঁহার বক্তব্যে উল্লেখ করেন নাই।


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবি হিসাবে সকল বাঙ্গালীর মাথার মনি। কবিগুরু ছাড়া বাঙ্গালীর যে কোন আলোচনাই অসম্পূর্ণ থাকিয়া যায়। তৈল বিষয়ক কবিতা রচনার পাশাপাশি তৈলের গুণগান করিয়া কবিগুরু বিজ্ঞাপনেও নাম লেখাইয়াছিলেন। ''অলকানন্দা তৈল সামান্য মাখিলেই চুল ওঠে'', কবিগুরু কৃত এই তৈলের সার্টিফিকেটটি রসিক কবির বিজ্ঞাপন প্রতিভার এক অনন্য স্মারক। কুন্তলীন কেশ তৈলের বিজ্ঞাপনে কবিগুরু বলিয়াছেন, “কুন্তলীন তৈল আমরা দুইমাস কাল পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছি। আমার কোন আত্মীয়ের বহুদিন হইতে চুল উঠিয়া যাইতেছিল। কুন্তলীন ব্যবহার করিয়া একমাসের মধ্যে তাঁহার নূতন কেশোদাম হইয়াছে। এই তৈল সুবাসিত, এবং ব্যবহার করিলে ইহার গন্ধ ক্রমে দুর্গন্ধে পরিণত হয় না”। অপর একটি বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলিয়াছেন, “কুন্তলীন ব্যবহার করিয়া এক মাসের মধ্যে নূতন কেশ হইয়াছে”। তিনি অবশ্য বলেন নাই, কাহার কেশ? কবিগুরুর বিজ্ঞাপনবার্তাসমূহ কতটা সত্যাশ্রয়ী কিংবা তাঁহার চুল দাঁড়ির পিছনে কোন তেলের অবদান সব চাইতে বেশী, তাঁহা অবশ্য নিশ্চিত করিয়া বলা মুশকিল।


তবে, ব্রিটিশ রাজের আশীর্বাদপুষ্ট, অভিজাত বাঙ্গালী জমিদার এবং ব্যবসায়ী হিসাবে রবিঠাকুর তৈল কলের মালিক ও সাধারণ প্রজাদের নিকট হইতে তৈলপ্রাপ্ত হওয়া কিংবা রাজানুগ্রহ এবং রাজতোষণে ব্যপৃত না হওয়ার কোন সঙ্গত কারণ নাই। রবিঠাকুর তাঁহার পূর্ব ও পশ্চিম (১৯০৮) গ্রন্থে উল্লেখ করিয়াছেন, ‘যে ভারতবর্ষ অতীতে অঙ্কুরিত হইয়া ভবিষ্যতের অভিমুখে উদ্ভিন্ন হইয়া উঠিতেছে, ইংরেজ সেই ভারতের জন্য প্রেরিত হইয়া আসিয়াছে। সেই ভারতবর্ষ সমস্ত মানুষের ভারতবর্ষ - আমরা সেই ভারতবর্ষ হইতে অসময়ে ইংরেজকে দূর করিব, আমাদের এমন কী অধিকার আছে’। তিনি আরও বলিয়াছেন, ‘এসো হে আর্য,এসো অনার্য, হিন্দু মুসলমান। এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ, এসো এসো খৃষ্টান’ (গীতাঞ্জলী, ১৯১০)। ইহা ছাড়া, ভারতের জাতীয় সঙ্গীত “জনগনমন অধিনায়ক জয় হে ভারত ভাগ্যবিধাতা” গানটি তিনি ১৯১১ সালে ব্রিটিশ শাসক পঞ্চম জর্জের ভারত আগমন কে উদ্দেশ্য করিয়া রচনা করিয়াছিলেন বলিয়া জানা যায়।

শুধু রবিঠাকুর কেন, প্রয়োজনে তৈলের শরনাপন্ন হন নাই এমন মানুষ খুজিয়া পাওয়া কঠিন। চন্দ্রগুপ্ত হইতে হিটলার, অশোক হইতে আকবর, সকলেই তৈল পছন্দ করিতেন। আর কৌটিল্য হইতে শুরু করিয়া বীরবল, গোপাল ভাঁড় হইতে শুরু করিয়া গোয়েবলস, সবাই কমবেশী তৈলচর্চা করিয়াছেন বৈ কি! মোদ্দা কথায়, তৈলমর্দন মানবকুলের অন্যতম সনাতন একটি প্রবৃত্তি।


তৈলের বিপুল মহিমাহেতু রবীন্দ্রনাথসহ বিশিষ্ট বাঙ্গালীর লেখালেখিতেও তৈলের প্রভাব সুস্পষ্ট। রবিঠাকুর তাঁহার ‘দুরন্ত আশা’ কবিতায় সাধারণ, অনভিজাত এবং অলস প্রকৃতি বাঙালীর স্বরূপ উদঘাটনে তৈলকে টানিয়া আনিয়াছেন, ‘অলস দেহ ক্লিষ্টগতি - গৃহের প্রতি টান।/তৈল-ঢালা স্নিগ্ধ তনু নিদ্রারসে ভরা,/মাথায় ছোটো বহরে বড়ো বাঙালি সন্তান।‘ নজরুলের ভাষায়, তৈল প্রয়োজনীয় একটি বস্তু যাহা চৈতনেও (টিকি) লাগাইতে হয়। অপর দিকে, বঙ্কিম চন্দ্র ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ পুস্তকের ‘বড় বাজার’ প্রবন্ধে তৈলের এক হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা লিপিবদ্ধ করিয়াছেন, “...কলু পট্টিতে গেলাম; দেখিলাম, যত উমেদার, মোসায়েব, সকলে কলু সাজিয়া তেলের ভাঁড় লইয়া সারি সারি বসিয়া গিয়াছে। তোমার ট্যাঁকে চাকরি আছে, শুনিতে পাইলেই, পা টানিয়া লইয়া, ভাঁড় বাহির করিয়া, তেল মাখাইতে বসে। চাকরি না থাকিলেও - যদি থাকে এই ভরসায়, পা টানিয়া লইয়া, তেল লেপিতে বসে। তোমার কাছে চাকরি নাই – নাই নাই - নগদ টাকা আছে ত - আচ্ছা, তাই দাও - তেল দিতেছি। কাহারও প্রার্থনা, তোমার বাগানে বসিয়া তুমি যখন ব্রাণ্ডি খাইবে, আমি তোমার চরণে তৈল মাখাইব - আমার কন্যার বিবাহটি যেন হয়। কাহারও আদ্দাশ, তোমার কানে অবিরত খোষামোদের গন্ধ তৈল ঢালিব - বাড়ীর প্রাচীরটি যেন দিতে পারি। কাহারও কামনা, তোমার তোষাখানার বাতি জ্বালিয়া দিব – আমার খবরের কাগজখানি যেন চলে। শুনিয়াছি,কলুদিগের টানাটানিতে অনেকের পা খোঁড়া হইয়া গিয়াছে। আমার শঙ্কা হইল, পাছে কোন কলু আফিঙ্গের প্রার্থনায় আমার পায়ে তেল দিতে আরম্ভ করে। আমি পলায়ন করিলাম”। হায় রে তৈল!


হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁহার “তৈল” প্রবন্ধে ‘সর্বশক্তিমান’ তৈলের গুণকীর্তন করিয়াছেন এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলিয়াছেন, “যে তৈল দিতে পারিবে, তাহার বিদ্যা না থাকিলে প্রফেসর হইতে পারে, আহাম্মক হইলেও ম্যাজিস্ট্রেট হইতে পারে, সাহস না থাকিলে সেনাপতি হইতে পারে এবং দুর্লভরাম হইয়াও উড়িষ্যার গভর্নর হইতে পারে”। শাস্ত্রী মহাশয় মনে করেন, ‘এক তৈলে চাকাও ঘোরে আর তৈলে মনও ফেরে’।


সর্বোপরি, তৈল ছাড়া জীবন গতিহীন, শ্রীহীন। অবশ্য, তৈল কতটা মন্দের ভালো আর কতটা ভালোর মন্দ কিংবা কতটা দুর্যোগ নাশিনী আর কতটা দুর্যোগ দায়িনী, তাহা নিশ্চিত করিয়া বলা মুশকিল। তবে তৈলের সার্বজনীন ব্যবহার এবং গ্রহণযোগ্যতা উহাকে তাবৎ সমাজে এক বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করিয়াছে, সন্দেহ নাই। তৈল ছাড়া কোন কর্ম সমাধা হয় না, তৈল না পুড়িলে রাঁধাও নাচিতে ভুলিয়া যায়। তাই এই আলোচনার উপসংহারে গলা ছাড়িয়া বলিতে ইচ্ছা হয় ...


তেল নিয়ে নানা কথা নানাজনে কয়,

তেলের মর্ম বোঝা অত সোজা নয়!

কত যে তেলেসমাতি তেলের ভিতর -

কেউ জানে, কেউ তার রাখে না খবর।


তবে আপামর তৈলবাজ, তেলামাথা এবং তৈলখোরদের স্মরণ রাখা অতীব জরুরী ...


তেল মাখা কপালটা যদি হয় ফাটা -

চটচটে তেলে ঠিকই পিছলাবে পা টা।

যদি তেলে লেগে যায় আগুন হঠাৎ -

তেলবাজ, তেলা মাথা হবে কুপোকাত।


অতএব, সাধু সাবধান!


Komentarze


bottom of page